কীর্তন গান

কীর্তনগান বাঙালির এক অভিনব সৃষ্টি। কথা ও সুরের মিলনে কীর্তন বাঙালির এক দিব্য অবদান। কৃত শব্দের অর্থ প্রশংসা। কীর্তি ও কীর্তন এই দুই শব্দই কৃত ধাতু থেকে এসেছে। রূপে, জ্ঞানে, শৌর্যে ও কর্মে শ্রেষ্ঠতার নাম স্মরণ, গুণ বর্ণনা করাই হলো কীর্তন। ভক্ত ও সাধকগণ কীর্তন শব্দটি ঈশ্বরের নামকীর্তন অর্থেই ব্যবহার করেছেন। কীর্তন অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। দশম, একাদশ শতকে চর্যাগীতিতে সমবেত বা এককভাবে গান গাওয়ার রীতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঐতিহ্য সংকীর্তনের পূর্বসূরী। সর্বসাধারণের মধ্যে কীর্তন দ্বারা ভক্তি প্রচার করা ছিল চৈতন্যদেবের লক্ষ্য। ভক্তিবাদ প্রচার ও বিতরণের এমন মাধ্যম আর অন্য কোনো লোকধারায় দেখা যায় না। শ্রী চৈতন্যদেবের তীরোধানের পরই পদাবলী কীর্তন প্রকৃত লীলা কীর্তন-এর রূপ নেয়। এইভাবে পদাবলী নামকীর্তন, লীলাকীর্তন, রসকীর্তন, সংকীর্তন ইত্যাদি পর্যায়ে পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও ক্রমবিবর্তনে কীর্তন বর্তমান রূপধারায় প্রবহমান হয়ে আছে। খেতরীর মহোৎসবে বিধিবদ্ধভাবে কীর্তনগানের প্রথা প্রবর্তিত হয়। কীর্তনের বহু পদ লুপ্ত হয়েছে রক্ষণের অভাবে। পরবর্তী সময়ে অন্তর্হিত হয়ে মঙ্গলকাব্যের কবিরা চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গলের মাধ্যমে কীর্তনের রস পরিবেশন করতেন। এইভাবে বৌদ্ধগানের পর জয়দেবের গীতগোবিন্দ, মঙ্গলগান; চন্ডীদাস, বিদ্যাপতির মধ্য দিয়ে কীর্তনের ধারা অব্যাহত আছে। শ্রী চৈতন্যদেবের পূর্বে কীর্তনের সন্ধান শ্রী জয়দেব, বড়ু চন্ডীদাস, বিদ্যাপতির কাছ থেকে পাওয়া যায়। সে-সময়ে পদাবলী কীর্তনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। জয়দেবকৃত শ্রীগীতগোবিন্দে কীর্তনের ছন্দ, লোকাশ্রিত রাগ ও তালের সন্ধান পাওয়া যায়। ‘নাম লীলা গুণাদিনাং উচ্চে ভাষা তু কীর্তনম’ শ্রী হরির নাম, লীলা ও গুণাদির উচ্চভাষণই কীর্তন। নবধা ভক্তির দ্বিতীয় অঙ্গ কীর্তন। এই কীর্তন জপ নামেও পরিচিত। কীর্তন নামকীর্তন ও লীলাকীর্তনভেদে দুই প্রকার। নামকীর্তনে শ্রী হরির নাম ও করুণার কথাই প্রধান। আর লীলাকীর্তনে তার রূপ, গুণ ও বিবিধ মনোহরী লীলার বর্ণনাই প্রাধান্য লাভ করে। শ্রী গৌরাঙ্গদেবকে সংকীর্তনের জনক বলা হয়। সংঘবদ্ধভাবে হরিনাম কীর্তনের প্রথা তার প্রবর্তিত। সুকণ্ঠ গায়ক শ্রী স্বরূপ দামোদার লীলাকীর্তনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। কান্দরা, ময়নাডাল ও শ্রীখণ্ড মনোহর সাহী কীর্তনের তিনটি প্রধান ধারা। কীর্তনগানের অপর একটি প্রসিদ্ধ ধারার নাম রানীহাটি বা ‘রেনেটী’। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের লোকায়ত সুরাশ্রয়ী ও বাণীপুষ্ট রাগের প্রাচীন কীর্তনধারা ‘ঝাড়খণ্ডী’। কীর্তনের পাঁচ অঙ্গ: কথা, দোহা, আখর, তুক ও ছুট। এর মধ্যে আখর পদের ব্যঞ্জনা ও ব্যাখ্যাগত অংশ বলা চলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, কীর্তনের আখর কথার তান। কবিগুরু তার বহু গানের কথায় ভাঙ্গা কীর্তনের সুর প্রয়োগ করেছিলেন। কীর্তন বিষয়টিকে সুচারুভাবে ব্যাখ্যা ও বক্তব্য অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে শ্রোতার কাছে তুলে ধরা হয়। কীর্তন গান বিশুদ্ধ সুর ও তালে গাইতে হয়। গুরুর মুখে শুনে শ্রুতিপথে আয়ত্তে এনে কীর্তনকে আপন কণ্ঠে প্রয়োগ করে শ্রোতা সমাজে উপস্থাপন করতে হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কীর্তনের প্রয়োগ বেশ। পুরীধাম ও বাঙলায় কীর্তন-এর প্রচলন সর্বাধিক। কীর্তিনীয়াদের মধ্যে প্রাচীনকালে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, ব্রহ্ম হরিদাস, শ্রী মহাপ্রভু, শ্রীবাস পণ্ডিত সবিশেষ খ্যাত। শ্রীপুরীধামে কীর্তনীয়াগনের মধ্যেÑস্বরূপ দামোদার, দামোদার পণ্ডিত, শ্রী গোবিন্দ ঘোষ, বল্লভ সেন, ছোট হরিদাস বিখ্যাত। বাঙলায় ময়নাডাল, শ্রী নিবাস আচার্য, সরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রী শামানন্দ, রসিক দাস, গনেশ দাস, নন্দ কিশোর দাস, রাধাশ্যাম দাস, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, রাধারানী , রথীন ঘোষ, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিদাস কর, ব্রজেন সেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কীর্তনগানে মৃদঙ্গ শ্রীখোল, হারমোনিয়াম ও করতাল ব্যবহƒত হয়। কীর্তনে পালাগান গেয়ে তারপর মিলন গাইতে হয়। লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন চৌষট্টি রসের গান খ্যাত। বাঙলায় ‘ঢপকীর্তন’ কীর্তন নামে একটি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার রূপচাঁদ অধিকারী এর স্রষ্টা। যশোরের মধুসুদন কান এই ধারার একজন বিখ্যাত গায়ক ছিলেন। সংকীর্তন সম্যকরূপে কীর্তন। একাকী করা যায়, পাঁচজনেও করা যায়। হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে কলিতে সর্বাভীষ্ট লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় বলে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে অন্ত্যলীলার বিংশ পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে। ফলে এর প্রচলন দীর্ঘদিনব্যাপী। লীলাকীর্তনে সখ্য ও বাৎসল্য রসের পদ আছে। শ্রীরাধাকৃষ্ণের, শ্রীগৌরাঙ্গ নিত্যানন্দের জš§লীলাদির বর্ণন, নন্দোৎসব, ফলক্রয়লীলা, নৌকাবিলাস, নবনীপুরণ, গৌষ্ঠলীলা, শ্রীকৃষ্ণের সখাদের সঙ্গে বনবিহার এর পদ কীর্তনের প্রধান অঙ্গ। কীর্তনে কতগুলি ছন্দের বা তালের ব্যবহার দেখা যায়। কীর্তন ভেঙে বহুধরনের লোকধারায় সুর ব্যবহার করা হয়েছে। নিমাই সন্ন্যাস পালা, বৈষ্ণব গানে এর প্রভাব দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে কালীকীর্তন নামে এক প্রকার কীর্তন-এর সন্ধান পাওয়া যায়। কালী কীর্তন মূলত শাক্তপদাবলীর গীতিরূপ মাত্র। এতে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর লীলা মাহাত্ম পায়। দ্বিজরামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, নীলকণ্ঠের নাম সর্বজনবিদিত।
০০ শাহনাজ জয়া ০০
subscribe

Subscribe

Monitor continues to update the latest from This blog directly in your email!

oketrik

0 comments to কীর্তন গান :

Post a Comment