Showing posts with label নছিমনের গান. Show all posts
Showing posts with label নছিমনের গান. Show all posts

নছিমনের গান

0

Bookmark and Share
সাধারণত একটি নাট্যিক প্রযোজনার দুইটি উদ্দেশ্য বিদ্যমান থাকে। ক. আনন্দ দান খ. শিক্ষা দান। ঐ প্রযোজনাই সার্থক বলে বিবেচিত হয় যেখানে নির্মল আনন্দের সাথে সাথে শিক্ষার বিষয়টিও জোরদার হয়ে উঠে। বাংলাদেশের দেশজনাট্য হিসেবেÑনছিমন গানে এই দুই উদ্দেশ্যেরই সার্থকতা বিদ্যমান। গ্রামের মানুষদের হাতেই এই অসাধারণ গল্প কাহিনীর জন্ম। মূলত কিচ্ছা হিসেবে জন্ম হলেও যাত্রা শিল্পের প্রভাবে সংলাপত্তক গীত হিসাবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর আঙ্গিক প্রায় যাত্রারই অনুরূপ। মূলত কমলার বনবাস এবং রূপবানের গানের সংমিশ্রণে এর কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে। নছিমন গানের গল্পে দেখা যায়, জালেম বাদশাহ একদিন সকালে দেখেন প্রাসাদে ঝাড়ুদারনী আসেনি। ঝাড়ুদারনীকে নিয়ে আসা হলে ঝাড়ুদারনী রাজবাড়িতে কাজ করতে অসম্মতি জানায়। কারণ রাজা আটকুড়ে এবং এখানে কাজ করলে তার কপালে সুখ জুটবে না। বাদশাহ আরো জানতে পারেন শুধু বাড়ুদারনীই নয় দেশের সব মানুষই তার সম্বন্ধে এমনই ধারণা পোষণ করে। জালেম বাদশাহ তাই শোনে আত্মহত্যা করতে যান, কিন্তু সেখানে এক দরবেশ তাকে একটা ফুল দিয়ে বলেন এটি যদি রানী বেঁটে খায় তবে তার সন্তান হবে, কিন্তু বার বছর বয়স হলে তাকে বিয়ে দিয়ে সেই রাতেই বাণিজ্যে পাঠাতে হবে। অনুরূপ কাজও করা হয়। নছিমনের সাথে বিয়ের রাতেই আলম সাধুকে বাণিজ্যে পাঠানো হয়। স্বপ্নে এক রাতে আলম সাধু নির্দেশ পায়, নছিমনের সাথে মিলিত হবার। সে পাখির পিঠে উড়ে এসে নছিমনের সাথে মিলিত হয় এবং সেই রাতেই ফিরে যায়। আলম সাধু চলে গেলে অবিশ্বাসী হবে বলে নছিমন কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু গর্ভের লক্ষণ প্রকাশ হতেই রাণী নছিমনকে অসতি ভেবে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু নছিমনের কান্নার জন্য জল্লাদ তাকে পালিয়ে যেতে দেয়। নছিমন শত বিপদের মুখে পড়ে এবং এক সময় এক কাঠুরের বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং সেখানেই সন্তান জš§ দেয়। অন্যদিকে আলম সাধু বার বছর পর বাণিজ্য শেষে ফিরে এসে সব জানতে পারে এবং অস্থির হয়ে নছিমনকে খুঁজতে বের হয়। অবশেষে অনেক বিপত্তির পরে নছিমন ও তার সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। নছিমন গানে প্রথমেই জালেম বাদশাহকে দেখা যায় এবং অনুধাবন করা যায়, একজন শাসকের ভূমিকা সম্পর্কে। রাজ্যের প্রজাদের মঙ্গলই হওয়া উচিত রাজার প্রধান উদ্দেশ্য। জালেম বাদশাহকে তাই আদর্শ রাজা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো জাতির জন্য অপরিহার্য হলো সন্তান। সন্তান ছাড়া স্থবীর হয়ে পড়বে সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী, সব কিছু। সন্তানের মাধ্যমেই স্থাপিত হয় ভবিষ্যতের বীজ। আর রাজা হলেন প্রজাদের পিতাস্বরূপ। সে ক্ষেত্রে যদি রাজারই সন্তান না থাকে তবে সে কেমন করে প্রজাদের সাথে একান্ত হবে। অর্থাৎ এরই মাধ্যমে নছিমন গানে সন্তানের অপরিহার্যতার কথা প্রকাশিত হয়েছে। আলম সাধুর জš§ রাজ পরিবারে হলেও তাকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। তাই তার প্রধান কাজ হলো ব্যবসা। অর্থাৎ তার ধর্মই হলো ব্যবসা। তাই প্রয়োজনে বাসর রাতকে উপেক্ষা করে হলেওÑসকলের নিজের ধর্ম পালনীয়। যার প্রকাশ ঘটেছে আলম সাধুর মাঝে। নছিমন গানে গোপন মিলনের ভয়াবহতা তুলে ধরার স্পষ্ট প্রবণতা বিদ্যমান। সঙ্গম বিষয়টা তো গোপনীয়ই বটে। তথাপি সমাজসিদ্ধ অবস্থা ব্যতীত স্বামী স্ত্রীর গোপন সঙ্গমও যে ভয়ানক রূপ লাভ করতে পারে তারই প্রমাণ হলো নছিমন। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের প্রতি নছিমনের গান অসাধারণ শিক্ষা উপস্থাপন করেছে। নছিমনের গানের নায়িকা সতিসাবিত্রী নছিমন প্রতিনিয়ত বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু তার পরিণতি ভালো। বিনয়ী নছিমনের কান্নায় জল্লাদও তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আসলে জল্লাদ হার মেনেছে বলা যায়। যেমনটি দেখা যায় মনসা মঙ্গলে। আক্রমণাত্মক মনসা কখনোই আদায় করতে পারেনি পুরুষ-চাঁদ সৌদাগরের পুঁজা। কিন্তু বিনয়ী, সতী বেহুলা ঠিকই আদায় করেছে লক্ষ্মিন্দরের জীবন এবং মনসার প্রতি চাঁদের পুঁজা। কোমল নছিমনও কঠোর পরিবেশে কোমলভাবে আনুকূল্য আদায়ে সক্ষম হয়েছে। তাই এই সমাজে একজন নারীর আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে নছিমনের গান বিতর্কিত হলেও একটি পন্থা উপস্থাপন করেছে।

নছিমনের গান বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের উদ্ভাবনা তথাপি এর জনপ্রিয়তা প্রচুর। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ রাজশাহী, বগুড়া অঞ্চলে এর ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। নাটোরের, বনপাড়ার আরাজী ভবানীপুর গ্রামে এর নিয়মিত প্রযোজনা দেখা যায়। মূলত পৌষ, মাঘ মাসেই এটি বেশি পরিবেশিত হয় গ্রামের কৃষকের অভিনয় কৌশলে, বাড়ির আঙ্গিনায়। আর আমাদের গ্রাম বাংলায় নীরবে নিভৃতে নছিমনের গান নিজস্ব ঢংগে আনন্দ এবং একই সাথে শিক্ষা দিয়ে আসছে।
Read More >>