মোবারক হোসেন খান [লেখক: কথাশিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ]
মানব জীবনের সঙ্গে সঙ্গীত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের মানসিক বৃত্তি বিকাশে সঙ্গীতের ভূমিকা অপরিসীম। সংগীতানুশীলকে সার্বজনীন করা গেলে সংগীত সাধনার ভেতর দিয়ে সাংস্কৃতিক ভুবনে উন্নতি সাধিত হতে পারে।
সংগীতের একটা গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস আমাদের দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। সংগীত সেই সংস্কৃতিরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সংগীত শিক্ষা ও সংস্কৃতির আবশ্যকীয় উপাদান। সংগীত আবার নানা উপাদানে সমৃদ্ধ। এ সকল উপাদানে শ্রুতি, স্বর, রাগ, গ্রাম, অলঙ্কার, রস, বর্ণ, ভাব প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। সংগীতের এ সকল উপদানের মহিমা ও মাধুর্যকে ইতিহাসের নিরীখে জনসাধারণের কাছে পরিবেশন করার জন্যে একদিকে যেমন সঙ্গীত শিল্পীরা অক্লান্তভাবে ফলিত সঙ্গীতের অনুশীলন করছেন, অপরদিকে তেমনি অনুশীলনকারীরা সঙ্গীত-ইতিহাসের বিচিত্র উপাদান সংগ্রহ করছেন এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রচনা করছেন সংগীতের ইতিহাস, সংগীতের ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন। আর এভাবেই রচিত হয়েছে সঙ্গীতের ঔপপত্তিক বা শাস্ত্রীয় রূপ। শিল্প-সাধকেরা এর সাহায্য নিয়ে ব্যবহারিক সংগীত-রূপকে করছেন সমৃদ্ধ। অতএব সংগীতানুশীলনের মূলত দুটো দিক রয়েছে। একটি ঔপপত্তিক এবং অপরটি ব্যবহারিক। ঔপপত্তিকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সঙ্গীতের ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান ও দর্শন আলোচনা। রাগ, স্বর, শ্রুতি, বাদী, সমবাদী ইতাদি ব্যাকরণের পাশাপাশি কম্পোজিশন বা পাঠ্য-আলোচনা ঔপপত্তিকেরই অংশ।
সংগীত তেমনি আবার বিজ্ঞান। সায়েন্স বা ফিজিক্স বলতে সাধারণভাবে সঙ্গীতের বিজ্ঞান রূপায়িত। স্বরের কম্পন, শ্রুতির বিকাশ এই বিজ্ঞানের সাহায্যেই নির্ণীত হয়। আদিম যুগ থেকে ক্রমবিবর্তনের মাঝ দিয়ে বর্তমান যুগ পর্যন্ত যে একটা ধারাবাহিকতা সঙ্গীতের ভেতর পাওয়া যায় সেটাই হলো সঙ্গীতের ইতিহাস। মানুষের মন চিন্তা ও ভাবের রাজ্য। তাই মনোবিজ্ঞান বা মনের বিজ্ঞান তথা গঠন, বিকাশ প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে সঙ্গীতানুশীলন সার্থক হয় না। সঙ্গীতের দর্শন সঙ্গীতের স্বর বা শব্দ থেকে উদ্ভূত। তাই সঙ্গীত শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। কেননা সঙ্গীত মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর পারে নিয়ে যায় ও শাশ্বত শান্তি দান করে।
সঙ্গীতের স্বরকে আরো বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। স্বর হলো ধ্বনি। ধ্বনি সঙ্গীতের পরিভাষায় নাদ নামে পরিচিত। সঙ্গীতে এই নাদকে বলা হয়েছে, নিয়মি ও স্থির। আন্দোলন থেকে যে মধুর ধ্বনির উত্পত্তি তারই নাম নাদ। যে কোনো নাদ থেকেই কিন্তু সঙ্গীতের সৃষ্টি হতে পারে না। তাই নাদকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কোনো আঘাত ছাড়া যে নাদের সৃষ্টি সেটা হলো অনাহত নাদ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অনাহত নাদের কোনো প্রয়োজন হয় না। আঘাত দ্বারা উৎপন্ন স্থায়ী শব্দ হলো আহত নাদ। আহত নাদ থেকে সঙ্গীতের সৃষ্টি। নাদের উত্পত্তি সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ ধারাবাহিক একটা রূপ লাভ করে। আহত নাদ দু’প্রকার-বর্ণাত্মক ও ধ্বন্যাত্মক। কণ্ঠ দ্বারা গান গাওয়া, আবৃত্তি করা, বই পাঠ করা বর্ণাত্মক নাদ। কোনো বস্তুর দ্বারা কোনো বস্তুর ওপর আঘাত করলে যে নাদের উত্পত্তি হয় তার নাম ধন্যাত্মক নাদ।
সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় স্বরের মাধ্যমে। সঙ্গীতে সাতটি স্বরের প্রচলন রয়েছে। এই স্বরগুলো নির্ধারিত হয়েছে নাদ থেকে। আগেই বলা হয়েছে নাদ হলো ধ্বনি। ধ্বনি বা নাদের উত্পত্তি দুটো বস্তুর সংঘর্ষে বা আঘাতে। তার মানে, কোনো বস্তুর সংঘর্ষ থেকে যে আন্দোলন বা কম্পন হয়, তা থেকে ধ্বনি না নাদের উত্পত্তি।
নাদ থেকে শ্রুতির উদ্ভব। ঝঙ্কার ছাড়া শুধু শব্দের স্বরূপের শ্রবণ থেকে যে নাদের উত্পন্ন হয় সেটা শ্রুতি। সংগীতে বাইশটি শ্রুতি প্রচলিত। শ্রুতিগুলোর মনোরঞ্জনের গুণ রয়েছে। এই শ্রুতিই সংগীতের মূল ভিত্তি। শ্রুতিকে অবলম্বন করেই স্বরের নামকরণ করা হয়েছে। বাইশটি শ্রুতির মধ্যে সাতটি শ্রুতি মুখ্য। এগুলো হলো শুদ্ধ স্বর। সাংগীতিক পরিভাষায় এদের নাম ষড়জ, ঋষভ বা রেখাব, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিখাদ বা নিষাদ। সংক্ষেপে, সা রে গা মা পা ধা নি। এই সাতটি স্বরে বাইশটি শ্রুতি আছে।
নাদের কথা বলতে গিয়ে আন্দোলন বা কম্পনের উল্লেখ করা হয়েছে। দুটো বস্তুর সংঘর্ষের ফলে যখন সেই বস্তু দুটো নিজের জায়গা ছেড়ে উপরে-নিচে বা আশে-পাশে দুলতে থাকে সেটাই হলো আন্দোলন বা কম্পন।
সংগীতকে শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলতে হয়। শাস্ত্রীয় গ্রন্থে সঙ্গীতের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা আছে। অর্থাত্ সংগীতকে যে-সকল নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর দিয়ে চলতে হয় সেই নিয়মগুলো সঙ্গীতশাস্ত্রে বিধিবদ্ধ করা আছে।
সঙ্গীতের দুটো রূপ-তত্ত্বীয় বা ঔপপত্তিক ও ক্রিয়াত্মক বা ব্যবহারিক। তত্ত্বীয় শিক্ষার ওপর নির্ভর করে ক্রিয়াত্মক রূপে পারদর্শিতা অর্জন করা যায়। তবে সঙ্গীতের দুটো রূপ আয়ত্ত আনার ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করতে হলে শুধু শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেই চলে না, ব্যবহারিক বিদ্যাতেও পারদর্শিতা অর্জন করতেই হবে।
0 comments to সঙ্গীতের নানা রূপ :
Post a Comment