জালাল গীতি

আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। তার সংগীত ভাবনা তথা জীবনদর্শনে দ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। যুগে যুগে তার গান সঞ্চিত আবেগ হয়ে সমকালীন শিল্পীদের কণ্ঠকে করেছে মাধুর্যপূর্ণ। অখণ্ড বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের যে অংশটিকে ‘পূর্ব ময়মনসিংহ’ বলে অভিহিত করা হয় জালাল উদ্দীন খাঁ সেখানকারই মানুষ। এখনকার পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের কিছুসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদীর বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই সংস্কৃতির পরিমণ্ডল। বিশিষ্ট এই সংস্কৃতি অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল অনেক লোককবি ও লোকগীতিকাব্যের। এরকমই লোককবি ও লোকগীতিক সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ও রাধারমণ, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমহোন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথের প্রত্যক্ষ উত্তরসাধক বিংশ শতাব্দীর জালাল উদ্দীন খাঁ।
জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’ জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নামগুলো হলো- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। ‘জালালগীতিকা’র অধিকাংশ গানই এরকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন- ‘জালাল গীতিকা’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান ‘ভাটিয়ালি’ নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই ‘ভাটিয়ালি’। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে, আর ১৪টি ‘মুর্শিদি’ ও ১১টি ‘মারফতি’ নামাঙ্কিত গান। ‘জালাল গীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হতে ‘জালাল গীতিকা’র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়।
জালাল যদিও বাউল কবি বা বাউল গীতিকাররূপে পরিচিত, তবু মনে রাখা প্রয়োজন যে বাউল হচ্ছে বাংলার একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালির নাম এবং এই নামের বিশিষ্ট সাধন প্রণালিটির সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তবে তা না থাকলেও, বাউলসহ সকল লৌকিক ধর্মেরই অন্তঃসার যে বিদ্রোহী চেতনা, সে চেতনাই জালাল গীতি পুরোপুরিই ধারণ করেছে। তাই তার গানেও এই বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে অজান্তেই সমকালীন সময়ে জালাল রচিত সংগীতের ধারাটিকে সজীব রাখছেন সারা দেশের অনেক গায়ক। এদের মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুরের আবুল কাশেম তালুকদার ২০০৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন। অন্ধ গায়ক সুনীল কর্মকার এ দেশে তো বটেই, মার্কিন দেশে গিয়েও জালাল গীতি পরিবেশন করে রসিকজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জালালের শেষতমা পতœীর গর্ভজাত পুত্র আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও তার সাধনার ধারাকে আপন সাধ্যমতো বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন।
subscribe

Subscribe

Monitor continues to update the latest from This blog directly in your email!

oketrik

0 comments to জালাল গীতি :

Post a Comment