চৈত্র সংক্রান্তিতে লোকায়ত বাংলার গাজন-চড়ক উৎসব উত্তরবঙ্গে গম্ভীরা নাম নিয়েছে। শব্দটি সম্পর্কে বহু মত প্রচলিত। গম্ভীরা বলতে ব্যুৎপত্তিগতভাবে মধ্যযুগে দেবগৃহ বা মন্দির বোঝায়, কিন্তু গম্ভীরা পূজা ও উৎসব আদিতে মন্দিরে ছিল না। সূর্যপূজা পরবর্তী পর্বে শৈবধর্ম প্রভাবে এটি শিব পূজায় রূপান্তরিত হয়েছে। ধর্ম ঠাকুর বা সূর্যপূজায় গামার কাঠের পিঁড়ি ব্যবহৃত হয়। এই গামার শব্দটিই সম্ভবত সংস্কৃতায়িত হয়ে গম্ভীরা হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে মূলত এই গম্ভীরাপূজা ও উৎসব হওয়ায় তার সঙ্গে সূর্যপূজার সম্পর্ক নিরূপণ করা সহজ। তাছাড়া বাংলার কোথাও কোথাও গম্ভীরা নামে পরিচিত শিব। এই শিবের গাজনের (গাজন: ধর্মমঙ্গলের কাহিনী থেকে জানা যায় রানী রঞ্জাবতী ধর্মকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে গাজন উৎসবের প্রচলন করেন। ইন্দো-মঙ্গোলয়েডভুক্ত কোচ, রাজবংশী, পলিয়া এবং মাহালী , হাঁড়ি, বাগদী, কেওট, নুনীয়া, চামার, পোদ নাগর, ধানুক চাঁই, তুড়ী ইত্যাদি সম্প্রদায়ভুক্ত অবর্ণ হিন্দুরা এর আদি পূজক হলেও ইদানীংকালে এই পূজা ও উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ও অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ দেড় হাজার বছরের এই গম্ভীরা উৎসব যে প্রাচীন উৎসব- যার প্রাচীনতম তথ্য মিলে চীনা পরিব্রাজক হিউ এন সাংয়ের বিবরণীতেও। চৈত্র সংক্রান্তি ও তার পূর্বের চারদিনের পূজার মধ্যে রয়েছে ঘটভরা, ছোট তামাসা, বড় তামাসা, আহারা ইত্যাদি।
গম্ভীরা
গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য: তান্ত্রিক ও ঐন্দ্রজালিক এই নৃত্য গম্ভীরা পূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পূর্বে নিম ও ডুমুর কাঠ দিয়েই এই সব মুখোশ তৈরি হতো। কাগজের মণ্ড দিয়েও এ নৃত্যের মুখোশ তৈরি হতো। ধর্মীয় আচারযুক্ত এসব মুখোশের নির্মাণ ও সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল। চামুণ্ডা, ঝাঁটাকালী, কালী, উগ্রচণ্ডা, নারসিংহী ইত্যাদি এর একক নৃত্য।
গম্ভীরা গান: শতবর্ষ পূর্বে গম্ভীরা পূজার (শিব পূজা) সঙ্গে আজকালের গম্ভীরা গানের কোনো সর্ম্পক নেই। কারণ তখন বোলানের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক জীবনের বিবরণ দেওয়া হতো প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের পর লোকসমাজের রুচির তাগিদে সামাজিক লোকনাট্যের রূপ নিয়েছে। গম্ভীরা গানের অনুষ্ঠানের কতিপয় ভাগ মুখপাদ, বন্দনা, দ্বৈত পালাবন্দি গান, খবর বা রিপোর্ট। পূর্বে এ গানের অনুষঙ্গ ছিল ঢোল, পরে হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা ও জুঁড়িও যুক্ত হয়েছে। গানের সঙ্গে তাৎক্ষণিক সংলাপ ও রঙ্গরসিকতায় এটি লোকনাট্যের এক বলিষ্ঠ অংশ। অবিভক্ত মালদার ভোলাহাট শিবগঞ্জ ছিল এর পীঠস্থান। বর্তমানে আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রচলিত গম্ভীরায় নানা ও নাতির মধ্যে সংলাপ বিনিময় হয় এবং সাম্প্রতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ইসুগুলো গুরুত্ব পায়।
0 comments to গম্ভীরা :
Post a Comment