ধামাইল গান

বাংলাদেশের বিয়ের গানের সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে ধামাইল গান। ধামাইল গান মূলত নৃত্যসংবলিত। কাহিনীমূলক সংগীত বলে এ ধরনের পরিবেশনা রীতি 'ধামাইল নাচ' নামেও সমধিক পরিচিত। সাধারণত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে উপলক্ষে এ ধামাইল নাচ সংগীত সহযোগে পরিবেশিত হয়। এ নাচের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে এ নাচ স্ত্রীসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১০ থেকে ২৫ জন স্ত্রীলোকে বাড়ির খোলা কোনো স্থানে চক্রাকারে দাঁড়িয়ে তালে তালে করতালি দিয়ে গীত সহযোগে এই ধামাইল নাচ পরিবেশন করেন। ধামাইল নাচ যেহেতু একটি বিশেষ সম্পর্কের ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে পরিবেশিত হয়, তাই এ নাচে শ্যালিকা, বৌদি, দাদি, নানী সম্পর্কের মহিলারাই এ পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। যাকে উপলক্ষ করে এ ধামাইল নাচ পরিবেশিত হয় তার সম্পর্কের মা-কাকী-মামি জাতীয় কেউ এই পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করতে বিধি-নিষেধ রয়েছে। এসব সম্পর্কের ব্যতিরেকে অন্য সবাই নাচে অংশগ্রহণ করেন। তবে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ-উৎসবে যেহেতু ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই তাই ধামাইল নাচের সময় সব মহিলাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন। আর শিশুদের অন্নপ্রাশনের সময় শিশুর মা-মামি-কাকী-দাদি-বোন-মাসি-পিসি-পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অংশগ্রহণ করেন এবং শিশুকে নিয়ে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠেন।
ধামাইল নাচ পরিবেশনের জন্য বিশেষ কোনো স্থান কিংবা মঞ্চের প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির ভেতর অথবা বাইরের উঠানে, ঘরের মেঝেতে কিংবা সামান্য একটু খোলা জায়গায় ১০/১৫ জন মহিলা গোল হয়ে এই নাচ পরিবেশন করেন। গ্রামাঞ্চলে ধামাইল গান ও নৃত্যে অপরূপ এক সংহতির পরিচয় পাওয়া যায়। ছোট, বড়, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর নারী মিলে সমবেতভাবে এই গান পরিবেশন করেন। শিল্পীরা সাধারণত করতালির মাধ্যমে এই গান গেয়ে চক্রাকারে নৃত্যের আঙ্গিকে ঘুরে ঘুরে ধামাইল নাচ পরিবেশন করেন। এই নাচ পরিবেশনের সময় কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করার ঐতিহ্য না থাকলেও সম্প্রতি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ধামাইল নাচের শিল্পীরা কিছু কিছু আসরে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোল ব্যবহার করেন। কিন্তু ব্যবহৃত সেই বাদ্যযন্ত্র এই নাচ পরিবেশনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। আসলে শিল্পীদের ছন্দময় করতালির মধ্যমে সমবেত টানা সুর, তাল এবং লয়ের সমন্বয়ে এই নাচ পরিবেশিত হয়। ধামাইল নাচের একটি আকর্ষণীয় অংশে ভাটিয়াল এবং উল্টো ভাটিয়াল নৃত্য করা হয়। এক্ষেত্রে নাচের দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বিভক্ত দুটি দল একবার কাছে এগিয়ে পর মুহূর্তে দূরে সরে যায়, যখন কাছে এগিয়ে আসে তখন তাকে ভাটিয়াল বলে আর যখন দূরে সরে যায় তখন তাকে উল্টো ভাটিয়াল বলে। ধামাইল নাচ পরিবেশনের শুরুতেই শিল্পীরা হাত দিয়ে এক 'থাপা' বা একবার করতালি দেন। পরে গানের চরম বা শেষ মুহূর্তে এই করতালির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, অর্থাৎ দুই থাপা, তিন থাপা, চার থাপা করে করতালির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং চরমে ওঠে একটি পর্বের ধামাইল নাচ পরিবেশন শেষ হয়। একটি পর্ব শেষ হতেই উপস্থিত নারী দর্শকরা উলুধ্বনি বা মঙ্গলধ্বনি দেন। এরপর একে একে অন্যান্য পর্বের ধামাইল নাচ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে সিলেটে প্রচলিত ধামাইল নাচ পরিবেশনের ৮৬ পর্বের কথা জানা যায়। বৃহত্তর সিলেটের পাশর্্ববর্তী নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় এই ধামাইল নাচের প্রচলন রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের করিমগঞ্জ, আসাম ও শিলচরেও ধামাইল নাচের প্রচলন রয়েছে।

*সাইমন জাকারিয়া
subscribe

Subscribe

Monitor continues to update the latest from This blog directly in your email!

oketrik

0 comments to ধামাইল গান :

Post a Comment