সারি গান

গানের দেশ, সুরের দেশ বাংলাদেশ। কেন না এত বৈচিত্র্যময় গানের সম্ভার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আধুনিক, জারি, সারি, মুর্শিদী, মারফতি, লালন, ভক্তিমূলক, ভাওয়াইয়া, পালা গান, ভাটিয়ালি থেকে শুরু করে আরও যে কত রকমের গান রয়েছে তা একবাক্যে বলা মুশকিল। অনেক গানের মধ্যে সরিগান হচ্ছে এক ধরনের লোকসঙ্গীত যা শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীত নামেও পরিচিত। কোন একটি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মাঝে কাজের গতি আনতেই সাধারণত সারিগান গাওয়া হতো। যেমন বড় বড় গাছের গুঁড়ি টানতে অথবা বাড়ির ছাদ তৈরির সময় ছাদ পেটাতে সবাই সমস্বরে সারিগান গেয়ে থাকে। নৌকা বাইচের সময় মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠা টানার তালে তালে এ গান গায় বলেই এর নাম হয়েছে সারিগান।
দলবদ্ধভাবে গানের তালে তালে কাজ করলে শ্রম লাঘব হয়, কাজে উদ্দীপনা বাড়ে এবং কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে সারি গানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এ ছাড়াও কোন কিছুর বরণ অনুষ্ঠানে পায়ে ঘুংঘুর পরে খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে নেচে একের পর এক সারিগান গাওয়া হতো। ওই অনুষ্ঠানটি কখনও কখনও একটানা তিন-চার দিন পর্যন্ত চলত। আর এ একটানা তিন-চার দিনই ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সারিগান চলতে থাকত। তবে মজার ব্যাপার হল একটানা তিন-চার দিন সারিগান গাওয়া হলেও কোন গানই রিপিট হতো না বা আবার গাওয়া হতো না। অর্থাৎ যে গানটি একবার গাওয়া হতো সেটি আর আবার গাওয়া হতো না। সুতরাং একের পর এক নতুন গান গাওয়া চলতে থাকত। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। বাস্তবে এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে এর সঠিক অনুভূতি অনুভব করা সম্ভব নয়।
সারিগানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণে। সেখানে সঙ্গীত অর্থেই ‘সারি’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। পরবর্তীকালে মোগল নৌ-সেনাদের নৌকা বাইচের অনুকরণে গ্রাম-বাংলায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার প্রচলন শুরু হলে তাতে এ সারিগানের প্রসার ঘটে।
আরও পরে কৃষি কাজের বিভিন্ন স্তরে, যেমন হাল বাওয়া, ফসল নিড়ানো ও কাটা, ফসল তোলা ইত্যাদি এবং ছাদ পেটানোর সময় কৃষক-শ্রমিকরা এ গান ব্যবহার করতে থাকে। এতে তাদের শ্রম লাঘব হতো। বর্তমানে সারিগান কেবল শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীতই নয়, চিত্তবিনোদন এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলার অন্যতম উপাদান হিসেবেও বিবেচিত। সারিগান গ্রামবাংলার মানুষের হƒদয়ে এক অনবদ্য আবেদনের সৃষ্টি করে।
সারিগান প্রধানত সমবেত কণ্ঠে পুরুষের গান, এককভাবে তা গাওয়া হয় না। তবে ছাদ পেটানোর কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকায় এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একত্রে সারিগান গায়। সারিগানে একজন বয়াতি থাকে, সে মূল গান গায় এবং ফাঁকে ফাঁকে দোহারদের ‘দিশা’ ধরিয়ে দেয়। দোহাররা সমবেত কণ্ঠে তা গেয়ে বয়াতিকে ক্ষণিক বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়।
সারিগান তালপ্রধান; অবস্থাভেদে দ্রুত ও ধীরলয়ে গাওয়া হয়। তালপ্রধান এ কারণে যে, নৌকা বাইচের বৈঠা পানিতে ওঠানামার তালে তালে, ছাদ পেটানোর তালে তালে এ গানের তাল রক্ষা করা হয়। বাইচের নৌকা যখন বৈঠার টানে দ্রুত ছুটে চলে তখন স্বাভাবিকভাবেই তা দ্রুত লয়ে গাওয়া হয়। কিন্তু যখন মাঝি-মাল্লারা নদীর বুকে দাঁড় টানে তখন নৌকার গতি থাকে মন্থর। তখন যে সারি গাওয়া হয় তা ধীরলয়েই হয়ে থাকে। মূলত কর্মে প্রেরণা, শ্রম অপনোদন ও চিত্তবিনোদন সারি গানের মূল উদ্দেশ্য। এ কারণেই সারিগানে বিষয়বৈচিত্র্য এসেছে। গানের বিষয়বস্তু হিসেবে রাধাকৃষ্ণ, হরগৌরী ও নিমাই বিষয়ক গান, নর-নারীর প্রেমমূলক গান, প্রশস্তিমূলক গান, মরমি গান, হাস্যকৌতুক ও আক্রমণাÍক গান এতে স্থান পায়। নৌকা বাইচের সময় সারিগানে ঢোল, মন্দিরা, করতাল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
সারিগান বছরের যে কোন সময় গাওয়া যায়। ছাদ পেটানোর সময় ছাড়া অন্য সময়ে এ গান পরিবেশনের স্থান হল নদ-নদী-হাওর-বাঁওড় আর কৃষি ক্ষেত। সারিগানের অঞ্চল বলতে সাধারণত পূর্ব এবং নিুবঙ্গের ভাটি অঞ্চলকে বোঝায়। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও এ গানের প্রচলন আছে। বিশেষত ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে সারিগান ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

জাকির হোসেন সরকার
subscribe

Subscribe

Monitor continues to update the latest from This blog directly in your email!

oketrik

0 comments to সারি গান :

Post a Comment