সারি গান

0

Bookmark and Share
গানের দেশ, সুরের দেশ বাংলাদেশ। কেন না এত বৈচিত্র্যময় গানের সম্ভার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আধুনিক, জারি, সারি, মুর্শিদী, মারফতি, লালন, ভক্তিমূলক, ভাওয়াইয়া, পালা গান, ভাটিয়ালি থেকে শুরু করে আরও যে কত রকমের গান রয়েছে তা একবাক্যে বলা মুশকিল। অনেক গানের মধ্যে সরিগান হচ্ছে এক ধরনের লোকসঙ্গীত যা শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীত নামেও পরিচিত। কোন একটি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মাঝে কাজের গতি আনতেই সাধারণত সারিগান গাওয়া হতো। যেমন বড় বড় গাছের গুঁড়ি টানতে অথবা বাড়ির ছাদ তৈরির সময় ছাদ পেটাতে সবাই সমস্বরে সারিগান গেয়ে থাকে। নৌকা বাইচের সময় মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠা টানার তালে তালে এ গান গায় বলেই এর নাম হয়েছে সারিগান।
দলবদ্ধভাবে গানের তালে তালে কাজ করলে শ্রম লাঘব হয়, কাজে উদ্দীপনা বাড়ে এবং কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে সারি গানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এ ছাড়াও কোন কিছুর বরণ অনুষ্ঠানে পায়ে ঘুংঘুর পরে খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে নেচে একের পর এক সারিগান গাওয়া হতো। ওই অনুষ্ঠানটি কখনও কখনও একটানা তিন-চার দিন পর্যন্ত চলত। আর এ একটানা তিন-চার দিনই ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সারিগান চলতে থাকত। তবে মজার ব্যাপার হল একটানা তিন-চার দিন সারিগান গাওয়া হলেও কোন গানই রিপিট হতো না বা আবার গাওয়া হতো না। অর্থাৎ যে গানটি একবার গাওয়া হতো সেটি আর আবার গাওয়া হতো না। সুতরাং একের পর এক নতুন গান গাওয়া চলতে থাকত। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। বাস্তবে এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে এর সঠিক অনুভূতি অনুভব করা সম্ভব নয়।
সারিগানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণে। সেখানে সঙ্গীত অর্থেই ‘সারি’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। পরবর্তীকালে মোগল নৌ-সেনাদের নৌকা বাইচের অনুকরণে গ্রাম-বাংলায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার প্রচলন শুরু হলে তাতে এ সারিগানের প্রসার ঘটে।
আরও পরে কৃষি কাজের বিভিন্ন স্তরে, যেমন হাল বাওয়া, ফসল নিড়ানো ও কাটা, ফসল তোলা ইত্যাদি এবং ছাদ পেটানোর সময় কৃষক-শ্রমিকরা এ গান ব্যবহার করতে থাকে। এতে তাদের শ্রম লাঘব হতো। বর্তমানে সারিগান কেবল শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীতই নয়, চিত্তবিনোদন এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলার অন্যতম উপাদান হিসেবেও বিবেচিত। সারিগান গ্রামবাংলার মানুষের হƒদয়ে এক অনবদ্য আবেদনের সৃষ্টি করে।
সারিগান প্রধানত সমবেত কণ্ঠে পুরুষের গান, এককভাবে তা গাওয়া হয় না। তবে ছাদ পেটানোর কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকায় এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একত্রে সারিগান গায়। সারিগানে একজন বয়াতি থাকে, সে মূল গান গায় এবং ফাঁকে ফাঁকে দোহারদের ‘দিশা’ ধরিয়ে দেয়। দোহাররা সমবেত কণ্ঠে তা গেয়ে বয়াতিকে ক্ষণিক বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়।
সারিগান তালপ্রধান; অবস্থাভেদে দ্রুত ও ধীরলয়ে গাওয়া হয়। তালপ্রধান এ কারণে যে, নৌকা বাইচের বৈঠা পানিতে ওঠানামার তালে তালে, ছাদ পেটানোর তালে তালে এ গানের তাল রক্ষা করা হয়। বাইচের নৌকা যখন বৈঠার টানে দ্রুত ছুটে চলে তখন স্বাভাবিকভাবেই তা দ্রুত লয়ে গাওয়া হয়। কিন্তু যখন মাঝি-মাল্লারা নদীর বুকে দাঁড় টানে তখন নৌকার গতি থাকে মন্থর। তখন যে সারি গাওয়া হয় তা ধীরলয়েই হয়ে থাকে। মূলত কর্মে প্রেরণা, শ্রম অপনোদন ও চিত্তবিনোদন সারি গানের মূল উদ্দেশ্য। এ কারণেই সারিগানে বিষয়বৈচিত্র্য এসেছে। গানের বিষয়বস্তু হিসেবে রাধাকৃষ্ণ, হরগৌরী ও নিমাই বিষয়ক গান, নর-নারীর প্রেমমূলক গান, প্রশস্তিমূলক গান, মরমি গান, হাস্যকৌতুক ও আক্রমণাÍক গান এতে স্থান পায়। নৌকা বাইচের সময় সারিগানে ঢোল, মন্দিরা, করতাল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
সারিগান বছরের যে কোন সময় গাওয়া যায়। ছাদ পেটানোর সময় ছাড়া অন্য সময়ে এ গান পরিবেশনের স্থান হল নদ-নদী-হাওর-বাঁওড় আর কৃষি ক্ষেত। সারিগানের অঞ্চল বলতে সাধারণত পূর্ব এবং নিুবঙ্গের ভাটি অঞ্চলকে বোঝায়। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও এ গানের প্রচলন আছে। বিশেষত ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে সারিগান ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

জাকির হোসেন সরকার
Read More >>

রবীন্দ্র সংগীত

0

Bookmark and Share
গান শোনেন অথচ রবীন্দ্রসংগীত শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলা গানের জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয় গান হলো রবীন্দ্রসংগীত। গানগুলোর কথা, সুর প্রতিটি সংগীতপ্রেমী মানুষের ভীষণ প্রিয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানগুলোই হলো রবীন্দ্রসংগীত। ঠিক কবে থেকে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা শুরু করেন তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। কারো মতে, ১২ বছর বয়স থেকে আবার কারো মতে, ১৪ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা শুরু করেন। সংগীত চর্চার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ গান লিখতে শুরু করেন। তিনি সারা জীবনে দুই হাজারের মতো গান রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো তাঁর গীতবিতান গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাতে উপনিষদ, হিন্দু পুরাণ ও সংস্কৃত কাব্যনাটক, বৈষ্ণব ও বাউল দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রসংগীতে সুরারোপের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সংগীতের নানা ধারার সুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' রবীন্দ্রনাথের এই রচনাটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এ গানটি কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে' গানের সুরে রচিত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নানা ধরনের গানের সুরের ব্যবহার করেছেন। আধুনিক মনস্ক রবীন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাবও খেয়াল করা যায়।
Read More >>

নজরুল সংগীত

0

Bookmark and Share
যাঁদের হাত ধরে আধুনিক বাংলা গান প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা পায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের লেখা গানগুলোই নজরুলসংগীত নামে পরিচিত। আধুনিক বাংলা গান এখন যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এর পেছনে নজরুলসংগীতের বড় অবদান রয়েছে। দারুণ সুর আর কথার এই গানগুলো সব সংগীতপ্রেমী মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশাত্মবোধ, স্রষ্টার প্রতি ভক্তি, প্রেম, বিরহ সব বিষয়ই স্থান পেয়েছে নজরুলের গানে। ১৯২০-এর দশকে নজরুল গান লিখতে শুরু করেন। তবে সংগীতের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে ছেলেবেলাতেই। লেটো গানের দলে যোগ দিয়ে তিনি সংগীতের লোকসুর আর সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য সংগীত এবং ফরাসি কবিতার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুলের গানে পরবর্তী সময়ে এগুলো প্রভাব ফেলেছে। নজরুল ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এই আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দানকারী অনেক গান লিখেছেন নজরুল। এই গানগুলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। নজরুলের জীবদ্দশায় বেশ কিছু গান বই আকারে বের হয়; যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুলবাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। নজরুল প্রায় তিন হাজারের মতো গান লিখেছেন। নজরুলের লেখা 'চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল' গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
গ্রন্থনা : তৈমুর ফারুক তুষার
Read More >>

গজল

0

Bookmark and Share
গজল সংগীতপ্রেমী সব মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। মৃদু সুরের গজল খুব সহজেই মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। গজল শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন'। তাই গজল গানকে প্রণয় সংগীতও বলা হয়। গজল গান দুটো পঙ্ক্তি নিয়ে রচিত। প্রতিটি খণ্ডকে 'শের' বলা হয়। অনেক 'শের' নিয়ে একটি গজল লেখা হয়। শের কখনো একই বক্তব্য নিয়ে লেখা হয় আবার কখনো এতে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা দেখা যায়। স্রষ্টার প্রতি ভক্তি, মানব মনের নানাবিধ দিক নিয়ে গজল লেখা। গজল গানে সুরের চেয়ে কথার প্রাধান্য বেশি। পারস্যের বিখ্যাত সাধক কবিরা যে গজলগুলো রচনা করেন তাতে গভীর দার্শনিক তত্ত্ব দেখা যায়। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী, মির্জা গালিব ও আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল গজল রচনায় কিংবদন্তি হয়ে আছেন। পারস্যে এই গজলের উৎপত্তি হয়। পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় গজল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফারসি ভাষায় গজলের বিকাশ হলেও গজল সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায় উর্দু ভাষায়। আরবি, ফারসি, পশতু ও উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, বাংলা এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়। ভারতীয় সংগীত পারস্য সংগীত দ্বারা প্রভাবিত হলে ভারতীয় গানের ধারায় গজল প্রবেশ করে। বাংলা গজল রচনার পথিকৃৎ হলেন অতুলপ্রসাদ সেন। পরে কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরে বাংলা গজল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
গ্রন্থনা : তৈমুর ফারুক তুষার
Read More >>

ঘাটু গান

0

Bookmark and Share
প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক ধরনের লোকগান হলো ঘাটু গান। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান পরিবেশন করা হতো বলে একে 'ঘাটের গান'ও বলা হয়। কেউ কেউ এই গানকে 'ঘেটু গান' বলে থাকে। নারীবেশে কিশোর বালক নৃত্য করে ঘাটু গান পরিবেশন করে। ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লার উত্তরাঞ্চল ও সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চলে একসময় ঘাটু গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ঘাটু গানের কেন্দ্রে থাকে এক বা একাধিক সুদর্শন কিশোর। এই কিশোররা সাধারণত লম্বা চুল ও সুকণ্ঠের অধিকারী এবং অল্প বয়স্ক হয়ে থাকে। এরা বংশপরম্পরায় ঘাটু গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। ঘাটু গানে প্রধানত রাধাকৃষ্ণের প্রণয় এবং আদি রসাত্মক বিষয়গুলো স্থান পায়। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে যখন নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে ভরে ওঠে তখন নৌকায় ঘাটু গানের আসর বসে। নৌকাগুলো ঘাটে ঘাটে দাঁড় করিয়ে ঘাটু গান পরিবেশন করা হয়। ঘাটু গানের দলের প্রধান গায়ককে বলে 'সরকার'। ষোল শতকের দিকে এই ঘাটু গানের প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে মগ্ন এক ভক্ত রাধা সেজে কৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ক্রমে তাঁর অনেক ভক্ত গড়ে ওঠে। শিষ্যদের মধ্যে ছেলেশিশুদের রাধার সখী সাজিয়ে নেচে নেচে বিরহ সংগীত পরিবেশন করা হতো। ক্রমে এই বালকরাই ঘাটু নামে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং এদের নিয়েই গড়ে ওঠে ঘাটু গানের দল। তবে বর্তমান আধুনিক সমাজে ঘাটু গানের জনপ্রিয়তা একেবারেই কমে এসেছে।
Read More >>

ধামাইল গান

0

Bookmark and Share
বাংলাদেশের বিয়ের গানের সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে ধামাইল গান। ধামাইল গান মূলত নৃত্যসংবলিত। কাহিনীমূলক সংগীত বলে এ ধরনের পরিবেশনা রীতি 'ধামাইল নাচ' নামেও সমধিক পরিচিত। সাধারণত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে উপলক্ষে এ ধামাইল নাচ সংগীত সহযোগে পরিবেশিত হয়। এ নাচের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে এ নাচ স্ত্রীসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১০ থেকে ২৫ জন স্ত্রীলোকে বাড়ির খোলা কোনো স্থানে চক্রাকারে দাঁড়িয়ে তালে তালে করতালি দিয়ে গীত সহযোগে এই ধামাইল নাচ পরিবেশন করেন। ধামাইল নাচ যেহেতু একটি বিশেষ সম্পর্কের ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে পরিবেশিত হয়, তাই এ নাচে শ্যালিকা, বৌদি, দাদি, নানী সম্পর্কের মহিলারাই এ পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। যাকে উপলক্ষ করে এ ধামাইল নাচ পরিবেশিত হয় তার সম্পর্কের মা-কাকী-মামি জাতীয় কেউ এই পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করতে বিধি-নিষেধ রয়েছে। এসব সম্পর্কের ব্যতিরেকে অন্য সবাই নাচে অংশগ্রহণ করেন। তবে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ-উৎসবে যেহেতু ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই তাই ধামাইল নাচের সময় সব মহিলাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন। আর শিশুদের অন্নপ্রাশনের সময় শিশুর মা-মামি-কাকী-দাদি-বোন-মাসি-পিসি-পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অংশগ্রহণ করেন এবং শিশুকে নিয়ে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠেন।
ধামাইল নাচ পরিবেশনের জন্য বিশেষ কোনো স্থান কিংবা মঞ্চের প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির ভেতর অথবা বাইরের উঠানে, ঘরের মেঝেতে কিংবা সামান্য একটু খোলা জায়গায় ১০/১৫ জন মহিলা গোল হয়ে এই নাচ পরিবেশন করেন। গ্রামাঞ্চলে ধামাইল গান ও নৃত্যে অপরূপ এক সংহতির পরিচয় পাওয়া যায়। ছোট, বড়, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর নারী মিলে সমবেতভাবে এই গান পরিবেশন করেন। শিল্পীরা সাধারণত করতালির মাধ্যমে এই গান গেয়ে চক্রাকারে নৃত্যের আঙ্গিকে ঘুরে ঘুরে ধামাইল নাচ পরিবেশন করেন। এই নাচ পরিবেশনের সময় কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করার ঐতিহ্য না থাকলেও সম্প্রতি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ধামাইল নাচের শিল্পীরা কিছু কিছু আসরে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোল ব্যবহার করেন। কিন্তু ব্যবহৃত সেই বাদ্যযন্ত্র এই নাচ পরিবেশনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। আসলে শিল্পীদের ছন্দময় করতালির মধ্যমে সমবেত টানা সুর, তাল এবং লয়ের সমন্বয়ে এই নাচ পরিবেশিত হয়। ধামাইল নাচের একটি আকর্ষণীয় অংশে ভাটিয়াল এবং উল্টো ভাটিয়াল নৃত্য করা হয়। এক্ষেত্রে নাচের দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বিভক্ত দুটি দল একবার কাছে এগিয়ে পর মুহূর্তে দূরে সরে যায়, যখন কাছে এগিয়ে আসে তখন তাকে ভাটিয়াল বলে আর যখন দূরে সরে যায় তখন তাকে উল্টো ভাটিয়াল বলে। ধামাইল নাচ পরিবেশনের শুরুতেই শিল্পীরা হাত দিয়ে এক 'থাপা' বা একবার করতালি দেন। পরে গানের চরম বা শেষ মুহূর্তে এই করতালির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, অর্থাৎ দুই থাপা, তিন থাপা, চার থাপা করে করতালির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং চরমে ওঠে একটি পর্বের ধামাইল নাচ পরিবেশন শেষ হয়। একটি পর্ব শেষ হতেই উপস্থিত নারী দর্শকরা উলুধ্বনি বা মঙ্গলধ্বনি দেন। এরপর একে একে অন্যান্য পর্বের ধামাইল নাচ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে সিলেটে প্রচলিত ধামাইল নাচ পরিবেশনের ৮৬ পর্বের কথা জানা যায়। বৃহত্তর সিলেটের পাশর্্ববর্তী নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় এই ধামাইল নাচের প্রচলন রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের করিমগঞ্জ, আসাম ও শিলচরেও ধামাইল নাচের প্রচলন রয়েছে।

*সাইমন জাকারিয়া
Read More >>

গাজীর গান

0

Bookmark and Share
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে গাজীর গান বেশ জনপ্রিয়। আউল-বাউল সাধকরা হিন্দু সমাজে যেমন দেহতত্ত্ব ও ভক্তিমূলক বাউল গান গেয়ে বেড়ান, ঠিক তেমনই মুসলমান সমাজে সাঁই, দরবেশ, গাজী-ফকিররাও ভক্তিমূলক তত্ত্বকথার মাধ্যমে জীবনবোধের গৌরবগাথা গানের মধ্য দিয়ে প্রচার করেন। এদের দর্শন হলো, মানুষের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা লুকিয়ে থাকেন। তার সাক্ষাৎ লাভের আশায় তারা খ্যাপার মতো গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ান। এখানে হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রিস্টানদের কোনো গণ্ডি নেই। আছে মানবধর্ম এবং মানবতা। মুসলমান হয়েও মুসলমানদের সব নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানের ওধর্ে্ব থাকেন গাজী। এরা মৈত্রী, সম্প্রীতির কথা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন। চিকিৎসাও করেন গরিব লোকের। অসুস্থ রোগীর গায়ে চামরের স্পর্শ ও ঝাড়ফুঁক দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। জলপড়া, তেলপড়াও দেন। বিনিময়ে টাকা কিংবা চাল নেন। গ্রামের সর্বত্র গাজীর দল ঘুরে ঘুরে তত্ত্বকথা প্রচার করেন। এদের মাথায় থাকে কাপড়ের টুপি, গলায় তসবি মালা আর হাতে চামর। কারও গলায় আবার দেখা যায় কোঁচ বা ফটিকের মালা। পরনে থাকে কালো ঢিলে আলখাল্লা। এরা সাধারণ মানুষের একেবারেই কাছাকাছি থাকেন এবং যে কোনো বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এজন্য সাধারণের কাছে গাজীরা পরম শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকেন। এরা গৃহস্থবাড়িতে ঢুকেই ছড়া বলতে শুরু করেন। এরপর গাজীর দল অনেক সময় একা বা দু'জন মিলে গান শুরু করেন। গাজীর গানে অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন, 'মুসলমান বলে গো আল্লা হিন্দু বলে হরি/ নিদানকালে যাবে রে ভাই একি পথে চলি/ দোয়ানি করিবা আল্লারে'...
Read More >>